বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের নেপথ্যে...
আমরা জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে “আমার সোনার বাংলা” গাই। কিন্তু জানেন কি গানটা কিভাবে জাতীয় সংগীতের জায়গা দখল করলো?
“আমার সোনার বাংলা” গানটি 1970 সালে জহির রায়হান তাঁর “জীবন থেকে নেওয়া” সিনেমায় ব্যবহার করেন। এই সিনেমাটিতে রূপক অর্থে বাংলাদেশের তৎকালীন অবস্থা ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো [১]। সিনেমাটিতে আনোয়ার হোসেন সে সময়ের দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, রওশন জামিলের দজ্জাল চরিত্র ছিলো পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের প্রতিচ্ছবি।
সিনেমাটি সেন্সরবোর্ডে আটকে দেওয়া হয়েছিলো কারণ পাকিস্তানী স্বৈরশাসকেরা এই ছবির অন্তর্নিহিত অর্থ ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো।
সিনেমাটির একটি দৃশ্যে গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে গিয়ে আনোয়ার হোসেন যখন দেশের প্রতি আবেগের কথা বলছিলেন, তখন তাঁর বন্ধু বলে উঠে- “…দেশ আর মাটি জাহান্নামে যাক, আগে নিজের কথা ভাবো।”
উত্তরে আনোয়ার হোসেন পথের পাশ থেকে একমুঠো মাটি হাতে তুলে নিয়ে বলেন - “ … আমার সোনার দেশের সোনার মাটিকে কলঙ্কিত হতে দিতে চাইনা বলেই তো দেশ দেশ করি…” এবং তারপর “আমার সোনার বাংলা” গানটি গাওয়া শুরু করেন [২]।
আমার মতে গানটি বঙ্গভঙ্গের জন্য লেখা হলেও জহির রায়হানের এই সিনেমাটিতে ব্যবহারের ফলে জনমানুষের হৃদয়ে গানটি তৎকালীন সময়ে গভীর দাগ কাটতে সমর্থ হয়। (এখানে উল্লেখ্য যে গানটির সুর গগন হরকরার থেকে অনুপ্রাণিত [৩])।
এরপর ১৯৭১ সালে ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহারে এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ঘোষণা করা হয় [৩]।
এবং দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে “আমার সোনার বাংলা”র প্রথম ১০টি চরণ স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে নির্বাচিত হয় [৩]।
১৯৭৫ সালের শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ দ্বীন মুহাম্মদকে চেয়ারম্যান করে জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের জন্য একটা কমিটি গঠন করেন। তাঁরা কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ এবং ফররুখ আহমেদের ‘পাঞ্জেরী’কে জাতীয় সংগীত হিসাবে প্রাথমিক ভাবে প্রস্তাব করেন। কিন্তু একাধিক ক্যু এর ফাঁকে পরে সেই কাজ আর আগায়নি [৪,৫]।
১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান উল্লেখ করেন- ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান ভারতীয় জাতীয় সংগীত। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন। আমার সোনার বাংলা গানটি আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থী বিধায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তন আবশ্যক।’ এবং ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ কে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব রাখা হয়। কিন্তু ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান নিহত হলে সেই প্রস্তাবও চাপা পরে যায় [৪,৫]।
শোনা যায়, এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর কট্টোর ইসলামিপন্থিদের সাপোর্ট পাওয়ার জন্য “আমার সোনার বাংলা” বিধর্মী কবির লেখা বলে পরিবর্তনের প্ল্যান/ প্রস্তাব করছিলেন। (যদিও কোন সরকারি কাগজে সেরকম কিছু পাওয়া যায়নি) [৫]।
২০০২ এ শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী (যিনি ১৯৭১ সালে আলবদর বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন) ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ (আল বদরের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড) জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের জন্য সুপারিশ করেন। এবং প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠান। কিন্তু সেই সরকারের আমলেই প্রস্তাবটি গৃহীত না হওয়ার ঘটনা জানা যায় [৪,৫] ।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে পূর্বে বিভিন্ন রাজনীতির সাথে জড়িত লোকজন একাধিকবার জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিল তবে কখনোই তা বাস্তবায়ন হয়নি।
তথ্যসূত্রঃ