বিশ্ববিদ্যালয়, ক্ষমতার রাজনীতি ও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একটা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ, বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা স্থান। গবেষণা মানুষের চিন্তাকে প্রসারিত করে। সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে মুক্ত চিন্তার প্রয়োজন সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। দুঃখের বিষয় হলো বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার পরিমাণ অতিশয় নগণ্য। এবং গত কয়েকবছর ধরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়েগুলোর অধঃগমনের যে রূপ দেখা যাচ্ছে সেক্ষেত্রে সেগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় কেন, আদৌ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলা যাবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ চলে আসছে। আর এই অধঃগমনের ফলাফল হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী অনেক ব্যাক্তিবর্গের মধ্যে মুক্তচিন্তার অপ্রতুলতাও প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে।
আহমদ ছফা ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটি কথা উল্লেখ করেছিলেন - “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি প্রধান অবদানের একটি হল পাকিস্তান আন্দোলনের মনস্তাত্ত্বিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ভিতটি তৈরি করা। দ্বিতীয় অবদান বাংলা ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদান এবং তৃতীয় অবদান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংকল্প ও কর্মপন্থার দিকনির্দেশনা। এই জনগোষ্ঠীর জীবনে ওই তিনটিই অত্যন্ত তাৎপৰ্যপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু জ্ঞানচর্চার যে আরও একটা বৈশ্বিক মানদণ্ড রয়েছে তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান বিশেষ কিছু নেই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অবস্থাটি এতদিন পরেও সেটি খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। আরও দুঃখের বিষয় হলো স্বাধীনতার এতবছর পর বাংলাদেশে পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণ বাড়ার পরেও জ্ঞানচর্চার এই বৈশ্বিক মানদণ্ডের অভাবটি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনীতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবকে এব্যাপারে দায়ী করা যেতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের লেজুরবৃত্তিক রাজনীতির কথাও কারও অজানা নয়। শিক্ষক নিয়োগের সময় যেখানে সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে বাছাই করার কথা, সেখানে আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি পুরোপুরিই রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি। বিশেষ করে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গ্রাজুয়েশনের পর শিক্ষক হিসাবে যোগদান করার ইচ্ছা থাকলে ছাত্রছাত্রীরা সেই সিন্ডিকেটের ক্ষমতাধারী শিক্ষকের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করে। এবং নিয়োগের সময় মেধার বদলে সেই রাজনৈতিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করেই নিয়োগ প্রদান করা হয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করবো। ঘটনাটি অত্যন্ত বন্ধুভাজন ব্যক্তির কাছ থেকে শোনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের একটি ব্যাচের (সঙ্গত কারণেই ব্যাচটির সেশন উহ্য রাখলাম) অনার্সে প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানধারীদের মাস্টার্সের থিসিসের উপদেষ্টা ছিলেন সাদা দলের। কিন্তু নিয়োগকারী কমিটির প্রধান নীল দলের হওয়ায় খুব কায়দা করে সেই ব্যাচের প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানধারী দুইজনকে বাদ দিয়ে ভিন্ন ব্যাচ থেকে নিজের দুইজন ছাত্রকে নিয়োগ প্রদান করেন।
এরকম চিত্র শুধুই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক নিয়োগের বর্তমান অবস্থা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নামে নিজের আত্মীয়স্বজনকে নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগবিধির পরিবর্তন করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়েও স্বজনভিত্তিক প্রভাষক নিয়োগের অভিযোগ শোনা গিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিয়োগে দূর্নীতি, ভর্তির দূর্নীতি নিয়েও বহুবার সংবাদপত্রে আলোচিত হয়েছে।
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের অন্যতম কোচ মাহবুব মজুমদারকে হয়তো অনেকেই চিনেন। তিনি আন্ডারগ্রাজুয়েট করেছিলেন MIT থেকে, মাস্টার্স করেছিলেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এরপর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ও ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্টডক করার পর বাংলাদেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতার জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু অজুহাত দেখিয়ে তাঁর আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়। এত নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি এবং পোস্টডক থাকা সত্ত্বেও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে পারেননি! অথচ ক্ষমতাসীন দলের ধামাধরা বেশ কয়েকজন তাঁর পরে খুব সহজেই শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেছিলো।
সত্যি বলতে শুধু প্রভাষকই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রেও ক্ষমতাসীন দলের ছায়ায় থাকা ব্যাক্তিদের নিয়োগে উৎসাহিত করা হয়। আমেরিকায় পিএইচডি করার সময় কলকাতার এক সহপাঠীর সাথে আলাপ হচ্ছিলো। সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটে যে দুজন উপাচার্য হিসাবে নিয়জিত ছিলেন তাদের কারোরই পিএইচডি ছিলোনা। কথায় কথায় এতথ্যটি বলতেই আমার কলকাতার বন্ধুটি আকাশ থেকে পরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পিএইচডি নেই, সেটা কীভাবে সম্ভব সেটি সে কিছুতেই বুঝতে পারছিলোনা। বাংলাদেশই সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে উপাচার্য হতে হলে পিএইচডির প্রয়োজনও পড়েনা। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলির বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতাকে রাজনৈতিক যোগ্যতার চেয়ে বড়ো করা দেখা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই নোংরা রাজনীতির প্রভাব আরও বেশি লক্ষ্য করা যায় আবাসিক হলের গণরুমগুলোতে। আমাদের সময়ে দেখেছি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে জায়গা পাবার জন্য ছাত্রছাত্রীদেরকে হলের নামধারী নেতারা ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক মিছিলে অংশ নিতে বাধ্য করতো। এখনও সেই চিত্রের খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে বলে জানা নেই। এতকিছুর পরেও অধিকাংশ গনরুমের পরিবেশ মোটেও বসবাসের যোগ্য নয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যের ছাত্রলীগকে “উন্নয়ন প্রকল্পে” দুইকোটি টাকা দেওয়ার খবর একসময় বেশ চাঞ্চল্য তুলেছিলো। এদিকে আবাসিক হল অথবা গবেষণাগার উন্নতির প্রসঙ্গে জুতোর তলা ক্ষয়ে ফেলার পরও উপরের প্রশাসনের কাছ থেকে কোন অনুদান পাওয়া কষ্টকর হয়ে উঠে।
বিশ্ববিদ্যালয় মানুষ গড়ার স্থান, শিক্ষকরা হলেন মানুষ গড়ার কারিগর আর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের হওয়ার কথা সর্বজন শ্রদ্ধেয়, শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অভিভাবক। কিন্তু রাজনৈতিক পরিচয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত এইসব ব্যক্তিরা অনিয়ম ও বিতর্কিত কর্মকান্ডের সাথে নিয়োজিত হয়ে নিজেদের সম্মানের স্থানটি ধুলোয় টেনে এনে মিশিয়ে দিচ্ছেন। একটি দেশের জন্য এর থেকে বড় দূর্ভাগ্য কী বা হতে পারে!
আমাদের সবারই স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নিজস্ব একটি আবেগ কাজ করে। আর সেই আবেগ থেকেই আমরা প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা চাই আমাদের দেশ, বিশ্ববিদ্যালয় আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটুক। শিক্ষক- ছাত্র রাজনীতির লক্ষ্য হওয়ার কথা সমাজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উন্নয়ন, গবেষণা ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন; ক্ষমতাসীন দলের পা-চাটা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজ শুধুই মুখস্ত বুলি শেখানো নয়, বরং নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করা; নবীনদের মুক্তভাবে চিন্তা করতে শেখানো। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব সেই জ্ঞানের পরিবেশকে সংরক্ষণ করা। আশার কথা হলো সবকিছু এখনও নষ্টদের হাতে চলে যায়নি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এখনও অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী রয়েছেন যারা তাঁদের সাধ্যমত এইসব অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। কেউ রাজপথে কেউ বা লেখনীর মাধম্যে।
যখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম, সাধ্যমত প্রতিবাদ করে গিয়েছি। কতটুকু সফল হয়েছি, বিনিময়ে কী পেয়েছি কখনও সেই হিসাব করা হয়নি। তবে অনলাইনে ও সামাজিক মাধ্যমে নবীনদের রুখে দাঁড়ানো দেখে মনে হয়েছে হয়তো নতুন সমাজ গঠনের সেই যে স্বপ্ন আমরা দেখতাম সেটা কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। এখন সময় এসেছে সেই আলোকবার্তাটুকু এই নবীনদের হাতে তুলে দেওয়ার। তবে তাঁরা একা নয়, আমরা ছিলাম এবং এখনও রয়েছি তাঁদের সাথে। এভাবেই হয়তো একসময়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অনিয়ম ও অন্যায় দূর হবে, মুক্ত চিন্তা ও গবেষণার প্রসার ঘটবে এবং বিশ্বময়ী বিদ্যার আলো ছড়াতে সক্ষম হবে।
আহমদ ছফা ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটি কথা উল্লেখ করেছিলেন - “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি প্রধান অবদানের একটি হল পাকিস্তান আন্দোলনের মনস্তাত্ত্বিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ভিতটি তৈরি করা। দ্বিতীয় অবদান বাংলা ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদান এবং তৃতীয় অবদান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংকল্প ও কর্মপন্থার দিকনির্দেশনা। এই জনগোষ্ঠীর জীবনে ওই তিনটিই অত্যন্ত তাৎপৰ্যপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু জ্ঞানচর্চার যে আরও একটা বৈশ্বিক মানদণ্ড রয়েছে তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান বিশেষ কিছু নেই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অবস্থাটি এতদিন পরেও সেটি খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। আরও দুঃখের বিষয় হলো স্বাধীনতার এতবছর পর বাংলাদেশে পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণ বাড়ার পরেও জ্ঞানচর্চার এই বৈশ্বিক মানদণ্ডের অভাবটি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনীতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবকে এব্যাপারে দায়ী করা যেতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের লেজুরবৃত্তিক রাজনীতির কথাও কারও অজানা নয়। শিক্ষক নিয়োগের সময় যেখানে সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে বাছাই করার কথা, সেখানে আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি পুরোপুরিই রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি। বিশেষ করে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গ্রাজুয়েশনের পর শিক্ষক হিসাবে যোগদান করার ইচ্ছা থাকলে ছাত্রছাত্রীরা সেই সিন্ডিকেটের ক্ষমতাধারী শিক্ষকের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করে। এবং নিয়োগের সময় মেধার বদলে সেই রাজনৈতিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করেই নিয়োগ প্রদান করা হয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করবো। ঘটনাটি অত্যন্ত বন্ধুভাজন ব্যক্তির কাছ থেকে শোনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের একটি ব্যাচের (সঙ্গত কারণেই ব্যাচটির সেশন উহ্য রাখলাম) অনার্সে প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানধারীদের মাস্টার্সের থিসিসের উপদেষ্টা ছিলেন সাদা দলের। কিন্তু নিয়োগকারী কমিটির প্রধান নীল দলের হওয়ায় খুব কায়দা করে সেই ব্যাচের প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানধারী দুইজনকে বাদ দিয়ে ভিন্ন ব্যাচ থেকে নিজের দুইজন ছাত্রকে নিয়োগ প্রদান করেন।
এরকম চিত্র শুধুই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক নিয়োগের বর্তমান অবস্থা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নামে নিজের আত্মীয়স্বজনকে নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগবিধির পরিবর্তন করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়েও স্বজনভিত্তিক প্রভাষক নিয়োগের অভিযোগ শোনা গিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিয়োগে দূর্নীতি, ভর্তির দূর্নীতি নিয়েও বহুবার সংবাদপত্রে আলোচিত হয়েছে।
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের অন্যতম কোচ মাহবুব মজুমদারকে হয়তো অনেকেই চিনেন। তিনি আন্ডারগ্রাজুয়েট করেছিলেন MIT থেকে, মাস্টার্স করেছিলেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এরপর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ও ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্টডক করার পর বাংলাদেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতার জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু অজুহাত দেখিয়ে তাঁর আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়। এত নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি এবং পোস্টডক থাকা সত্ত্বেও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে পারেননি! অথচ ক্ষমতাসীন দলের ধামাধরা বেশ কয়েকজন তাঁর পরে খুব সহজেই শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেছিলো।
সত্যি বলতে শুধু প্রভাষকই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রেও ক্ষমতাসীন দলের ছায়ায় থাকা ব্যাক্তিদের নিয়োগে উৎসাহিত করা হয়। আমেরিকায় পিএইচডি করার সময় কলকাতার এক সহপাঠীর সাথে আলাপ হচ্ছিলো। সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটে যে দুজন উপাচার্য হিসাবে নিয়জিত ছিলেন তাদের কারোরই পিএইচডি ছিলোনা। কথায় কথায় এতথ্যটি বলতেই আমার কলকাতার বন্ধুটি আকাশ থেকে পরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পিএইচডি নেই, সেটা কীভাবে সম্ভব সেটি সে কিছুতেই বুঝতে পারছিলোনা। বাংলাদেশই সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে উপাচার্য হতে হলে পিএইচডির প্রয়োজনও পড়েনা। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলির বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতাকে রাজনৈতিক যোগ্যতার চেয়ে বড়ো করা দেখা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই নোংরা রাজনীতির প্রভাব আরও বেশি লক্ষ্য করা যায় আবাসিক হলের গণরুমগুলোতে। আমাদের সময়ে দেখেছি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে জায়গা পাবার জন্য ছাত্রছাত্রীদেরকে হলের নামধারী নেতারা ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক মিছিলে অংশ নিতে বাধ্য করতো। এখনও সেই চিত্রের খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে বলে জানা নেই। এতকিছুর পরেও অধিকাংশ গনরুমের পরিবেশ মোটেও বসবাসের যোগ্য নয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যের ছাত্রলীগকে “উন্নয়ন প্রকল্পে” দুইকোটি টাকা দেওয়ার খবর একসময় বেশ চাঞ্চল্য তুলেছিলো। এদিকে আবাসিক হল অথবা গবেষণাগার উন্নতির প্রসঙ্গে জুতোর তলা ক্ষয়ে ফেলার পরও উপরের প্রশাসনের কাছ থেকে কোন অনুদান পাওয়া কষ্টকর হয়ে উঠে।
বিশ্ববিদ্যালয় মানুষ গড়ার স্থান, শিক্ষকরা হলেন মানুষ গড়ার কারিগর আর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের হওয়ার কথা সর্বজন শ্রদ্ধেয়, শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অভিভাবক। কিন্তু রাজনৈতিক পরিচয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত এইসব ব্যক্তিরা অনিয়ম ও বিতর্কিত কর্মকান্ডের সাথে নিয়োজিত হয়ে নিজেদের সম্মানের স্থানটি ধুলোয় টেনে এনে মিশিয়ে দিচ্ছেন। একটি দেশের জন্য এর থেকে বড় দূর্ভাগ্য কী বা হতে পারে!
আমাদের সবারই স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নিজস্ব একটি আবেগ কাজ করে। আর সেই আবেগ থেকেই আমরা প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা চাই আমাদের দেশ, বিশ্ববিদ্যালয় আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটুক। শিক্ষক- ছাত্র রাজনীতির লক্ষ্য হওয়ার কথা সমাজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উন্নয়ন, গবেষণা ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন; ক্ষমতাসীন দলের পা-চাটা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজ শুধুই মুখস্ত বুলি শেখানো নয়, বরং নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করা; নবীনদের মুক্তভাবে চিন্তা করতে শেখানো। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব সেই জ্ঞানের পরিবেশকে সংরক্ষণ করা। আশার কথা হলো সবকিছু এখনও নষ্টদের হাতে চলে যায়নি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এখনও অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী রয়েছেন যারা তাঁদের সাধ্যমত এইসব অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। কেউ রাজপথে কেউ বা লেখনীর মাধম্যে।
যখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম, সাধ্যমত প্রতিবাদ করে গিয়েছি। কতটুকু সফল হয়েছি, বিনিময়ে কী পেয়েছি কখনও সেই হিসাব করা হয়নি। তবে অনলাইনে ও সামাজিক মাধ্যমে নবীনদের রুখে দাঁড়ানো দেখে মনে হয়েছে হয়তো নতুন সমাজ গঠনের সেই যে স্বপ্ন আমরা দেখতাম সেটা কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। এখন সময় এসেছে সেই আলোকবার্তাটুকু এই নবীনদের হাতে তুলে দেওয়ার। তবে তাঁরা একা নয়, আমরা ছিলাম এবং এখনও রয়েছি তাঁদের সাথে। এভাবেই হয়তো একসময়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অনিয়ম ও অন্যায় দূর হবে, মুক্ত চিন্তা ও গবেষণার প্রসার ঘটবে এবং বিশ্বময়ী বিদ্যার আলো ছড়াতে সক্ষম হবে।