একটি বজ্জাত নিউট্রিনো এবং...

০৯/১১/২০১১

মাসদুয়েক আগের কথা। সকালবেলা ফেসবুক খুলে আমার চোখদু'টি ছানাবড়া হয়েগেলো!!! ছানাবড়া হবার কারন আর কিছুই নয়, সেটি ছিলো ফেসবুকে শেয়ার করা একটি খবর, যেটার মূল কথাটি ছিলো- "আলোর চেয়ে বেশি গতিসম্পন্ন কণা আবিস্কার। নিউট্রিনো আলোক কণার চেয়ে বেশি বেগে ছুটতে পারে!!!"
বলেকি?? অ্যাঁ যেখানে আলোর গতিবেগকে ধ্রুব ধরে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে শুরু করে কোয়ান্টাম ফিল্ড তত্ত্বের মতো বিশাল বিশাল আতেঁলিয় তত্ত্ব সমূহ দাড়িয়ে আছে সেখানে বজ্জাত নিউট্রিনোর এতো সাহস??
কোন ক্র্যাকপটের নিজস্ব ব্লগের লেখা বা ফেসবুকের নোট হলে হয়তো সেটা হাসির খোরাক হিসাবেই উড়িয়ে দেয়া যেতো। কিন্তু খবরটি মোটেও ফেলনা নয়, কারন প্রথমতঃ লিংকগুলি ছিলো BBC news, New York Times এর মতো বড় বড় পত্রিকার, আর দ্বিতীয়তঃ এই খবরটির দাবীদার হলেন স্বয়ং CERN এর Opera গ্রুপের বিজ্ঞানীরা
এই খবর দেখে অনেকেই যখন চায়ের টেবিলে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার কথা বলে মুখে ফেনা তুলছিলেন, তখন কিছুটা আশঙ্কায়, টেবিলে বসে বসে আমি কুল কুল করা ঘামছিলাম। কারন আর কিছুই নয়, আমার থিসিস। গত কয়েকমাস ধরে রাত জেগে বিচ্ছিরি সব হিসাব কষে কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরীর যে বিষয়টা (আমার থিসিস) প্রায় মিলিয়ে এনেছি, এই খবরটা পেয়ে মনে হতে লাগলো পুরো জিনিসটার উপর কেউ জল ঢেলে দিয়েছে। ওঁয়া ওঁয়া
CERN যেটি দাবী করছে, সেটি সঠিক হলে আমাদের বাউলাচুলো আইন্সস্টাইনের প্রায় ১০০ বছরের পুরানো আপেক্ষিকতা তত্ত্ব পুরোটাই নতুন করে লিখতে হবে!!! কেন? আসুন তবে দেখা যাক-
প্রথমেই আপেক্ষিকতার একটা উদাহরন দেই। ধরুন কেউ আপনার উপর ভয়ানক খেপে গিয়ে আপনাকে প্যাদানোর জন্য তাড়া করেছে। আপনিও নিজেকে বাচানোর জন্য প্রানপণে ছুট দিয়েছেন। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম আপনার তাড়াকারী ধ্রুব একটা গতিতে আপনাকে তাড়া করছে, সেটি হলো ১০ মি/ঘন্টা।

যাই হোক আপনি দৌড়াতে দৌড়াতে কিছুক্ষন পর পিছনে তাকিয়ে দেখলেন সে আপনার থেকে মাত্র ১ মিটার দূরে আছে। প্রান বাঁচাতে আর একটু জোরে ছুট লাগালেন।
এখন যদি আপনার দৌড়ের গতি , আপনার তাড়াকারী লোকটার সমান হয়ে যায় (অর্থাৎ ১০ মি/ঘন্টা), তাহলে সবসময়ই আপনাদের মধ্যকার দূরত্ব ঐ ১ মিটারই থাকবে। এভাবে যদি আপনারা সমবেগে দৌড়াতে থাকেন পিছনের লোকটি কখনই আপনাকে ধরতে পারবে না।
এখন যদি আপনি দৌড়ের গতি একটু বাড়িয়ে দেন (ধরি ১৫মি/ঘন্টা) , তাহলে দেখবেন আপনার তাড়াকারী আপনার থেকে প্রতি ঘন্টা ৫ মিটার করে পিছিয়ে পড়ছে।
এটা হলো আপেক্ষিকতার ছোট্ট একটি ধারনা। এবার একটু এগিয়ে যাওয়া যাক। ধরা যাক আপনি একটা রকেটে করে যাচ্ছেন, এবং সেটি আলোর থেকে বেশি গতিতে যেতে সক্ষম (মানে ১,৮৬,০০০ মাইল/সেকেন্ড এর থেকেও বেশি বেগে যেতে সক্ষম)।

আপনি সেটিকে আলোর গতিতে (সেকেন্ডে ১,৮৬,০০০ মাইল) চালিয়ে পৃথিবীর বাইরে চলে আসলেন। এখন পৃথিবী থেকে কেউ আপনার দিকে একটি টর্চ জ্বালালো। যদিও আপনি আলোর বেগেই ছুটছেন, তবুও আলো এসে আপনাকে ধরে ফেলবে।
এবার আপনি রেগে-মেগে রকেটের গতি বাড়িয়ে আলোর চেয়ে বেশি বেগে ছোটা শুরু করলেন। আবার কেউ পৃথিবী থেকে আপনার দিকে আলো ফেললো। এখন কি হবে?
যদিও এবার আপনি আলোর চেয়ে বেশি বেগে ছুটছেন, তবুও আলো এসে আপনাকে ধরে ফেলবে!!!!
এটা সম্ভব। কারন যেকোন জড়কাঠামোতে আলোর বেগ সবসময়ই ধ্রুব। এই জিনিসটি আইন্সস্টাইন ২৬ বছর বয়সে আবিস্কার করেছিলেন।

এবং আইন্সস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের দ্বিতীয় স্বীকার্য অনুযায়ী আলোর বেগকে ধ্রুব বলে দাবী করা হয়েছে।
এবং এই স্বীকার্য থেকে এটাও প্রমান করা যায়,যে শুধু মাত্র ভরহীন বস্তুই কেবল আলোর বেগে চলতে পারবে (এটা প্রমান করা খুব কঠিন নয়, সূত্রে বসিয়ে আপনি নিজেই বের করে ফেলতে পারবেন)। কিন্তু নিউট্রিনোর সামান্য ভর রয়েছে।
তাহলে নিউট্রিনো কিভাবে আলোর চেয়ে বেশিতে ছুটলো? এটা নিয়ে বর্তমানে CERN সহ সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা বেশ টেনশনে রয়েছেন। এমনকি অদ্ভুত কথা হলো, CERN এ যে বিজ্ঞানীরা এই ব্যাপারটি আবিস্কার করেছেন তারা নিজেরাও কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। Dr Ereditato এর বক্তব্য অনুযায়ী - "we are not claiming things, we want just to be helped by the community in understanding our crazy result - because it is crazy"
বিজ্ঞানীরা কি তাহলে হাল ছেড়ে দিলেন? আইন্সস্টাইনের ১০০ বছরের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব কি তাহলে ভুল প্রমানিত হলো? নাহ। বিজ্ঞানীরা এত তাড়াতাড়ি কোন কিছু মেনে নেন না। Dr Ereditato এর গ্রুপ CERN এর অন্য বিজ্ঞানীদেরকেও আহবান করেছেন। তাদের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আবার হিসাব কষে দেখা হচ্ছে। সম্ভবত নতুন করে আবারও পরীক্ষাটি করা হবে। কারন কণাটি যেহেতু নিউট্রিনো, কাজেই এর কোন বিশ্বাস নেই। (নিউট্রিনো খুব ছটফটে কণিকা, মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটিয়ে বসে, ব্যাখ্যা করার জন্য আরেকটা পোস্ট লাগবে) !!
ফোটন কণা (আলোক কণা) থেকে দ্রুত কণিকা আবিস্কার হলে একটি নতুন দ্বারের সম্ভাবনা উন্মোচিত হবে। সেটা হলো- সময় পরিভ্রমন !!
সময় পরিভ্রমন করা কি আসলেই সম্ভব হবে? সময়ই নাহয় সেটা বলে দেবে।


আপডেটঃ এঘটনার কয়েকমাস পরে Cern অনেক খুজাখুজি করে সমস্যাটা খুজে পায়। তাদের GPS এর এক ঢিলা কানেকশনের কারনে হিসাবে ভুলভাল এসেছিল। তারা দুঃখ প্রকাশ করে এবং একই সাথে আলোর থেকে গতিশীল নিউট্রিনোর তত্ত্বের সেখানেই অবসান ঘটে।

দেঁতো হাসি
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/41936